বাংলাদেশে বিনিয়োগ: চীনা কোম্পানির ধারণা

প্রকাশিত: 2:25 PM, February 17, 2022

খ্য ছাংলিয়াং: সামগ্রিকভাবে, বাংলাদেশে বিনিয়োগের ব্যাপারে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে অসামঞ্জস্যপূর্ণ ধারণা রয়েছে। যদিও বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য বিনিয়োগ ফোরাম, রোডশো এবং অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে, তথাপি সরকার এখনও পর্যন্ত একটি মূল সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হয়েছে। তাহলো বাংলাদেশে বিনিয়োগের অপরিবর্তনীয়তা কোথায় বা অন্যান্য দেশের চেয়ে কেন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করবেন?

উদাহরণ হিসাবে, ২০২০ সালের পুরো বছরে বাংলাদেশ ২.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে, যার মধ্যে মাত্র ৯৬০ মার্কিন ডলার মিলিয়ন ছিল নতুন বিনিয়োগ এবং বাকিটা ছিল ঘূর্ণায়মান বিনিয়োগ। একই বছরে বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ইন্দোনেশিয়া ১৮.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ভিয়েতনাম ১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণ করেছে। এমনকি করোনা মহামারী দ্বারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ভারত ৬৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করেছে। গত এক দশকে বাংলাদেশের একটি ভালো অর্থনৈতিক এবং স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি রয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগের জন্য উপযোগী, কিন্তু বাংলাদেশে অপূরণীয় বিনিয়োগের আকর্ষণ নেই। এর পিছনে কতগুলো প্রধান বাধা রয়েছে।

প্রথমত, বিনিয়োগ অনুমোদন প্রক্রিয়া দীর্ঘ, যার ফলে বিনিয়োগের রিটার্ন দ্রুত আদায় করা যায় না। বিনিয়োগের পর রিটার্নের জন্য সময় গুরুত্বপূর্ণ। যদিও বাংলাদেশ সাম্প্রতিক বছরগুলিতে বিনিয়োগ পদ্ধতি সহজ করার জন্য কাজ করছে, কিন্তু প্রতিটি অনুমোদন প্রক্রিয়া এখনও দীর্ঘ সময় নেয়। কিছু চীনা অর্থায়নকৃত বিনিয়োগকারী যারা বাংলাদেশে এসে উৎসাহের সাথে বিনিয়োগের সুযোগ নিলেও, দীর্ঘ প্রক্রিয়ার কারনে ক্লান্ত হয়ে বিনিয়োগ থেকে ফিরে এসেছেন।

দ্বিতীয়টি হল বাংলাদেশে এজেন্সি সংস্কৃতির প্রচলন। স্থানীয় ব্যবসায়ী সম্প্রদায় শুধুমাত্র একটি এজেন্ট হতে চায় এবং কোন বিনিয়োগ করতে চায় না। যখন বিদেশী বিনিয়োগ বাংলাদেশে প্রবেশ করে এবং সহযোগিতা চায়, তখন তারা প্রথমেই চিন্তা করে কীভাবে কোনো ঝুঁকির চাপ ছাড়াই এজেন্টে হয়ে কাজ করা যায় এবং স্বার্থ রক্ষা হয়। যার ফলে যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কোম্পানি শেষ পর্যন্ত চীনা পুঁজির সমস্ত অংশ নেওয়ার পরিস্থিতির দিকে এগিয়ে যায়। বাংলাদেশে পুঁজি ও স্থানীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর এরকম আচারন দেখে, বিদেশী বিনিয়োগকারীদের স্থানীয় বিনিয়োগ পরিবেশের উপর আস্থা অনেকটাই কমে গেছে।

তৃতীয়ত, অগ্রাধিকারমূলক নীতি বিশেষ করে অগ্রাধিকারমূলক কর নীতিগুলি যথেষ্ট নয়। নতুন শক্তি শিল্পে ফটোভোলটাইক প্রকল্পগুলিকে উদাহরণ হিসাবে গ্রহণ করা যায়। বাংলাদেশ সরকার সক্রিয়ভাবে সবুজ শক্তি বাস্তবায়নের প্রচার করছে এবং বিপুল সংখ্যক চীনা উদ্যোগ বাংলাদেশে ফটোভোলটাইক পাওয়ার স্টেশন বা ফটোভোলটাইক শিল্প পার্ক নির্মাণে বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজছে। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের প্রস্তাব জমা এবং অনুমোদনের পদ্ধতিকে সহজ করার জন্য “আন্তরিকতা” নিয়ে আসেনি এবং সংশ্লিষ্ট শিল্পের জন্য কর প্রণোদনা মধ্যপ্রাচ্যের তুলনায় প্রতিযোগিতামূলক নয়।

চতুর্থত, বিনিয়োগের জন্য সহায়ক অবকাঠামো যথেষ্ট উপযুক্ত নয়। উদাহরণ হিসেবে গ্যাসে বিনিয়োগের কথা বলা যায়, বাংলাদেশে বর্তমান সহায়ক সুবিধা যেমন গ্যাস টার্মিনাল, গ্যাস স্টোরেজ এবং গ্যাস ট্রান্সমিশন অসম্পূর্ণ। তাই এই খাতে আরও বিনিয়োগ ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন।

পঞ্চমত, ক্ষেত্র বিশেষ দুর্নীতি প্রবল এবং প্রতিটি অনুমোদন প্রক্রিয়ায় সমস্ত প্রাসঙ্গিক দলকে তাদের নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের জন্য বিশেষভাবে মন রক্ষা করতে হয়। বিনিয়োগের আগে বড় পরিমাণ কমিশন বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করতে অনীহা সৃষ্টি করেছে।

অবশ্যই, বাংলাদেশ চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশগ্রহণকারী এবং চীন সবসময়ই বাংলাদেশের সাথে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য বিনিময়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়েছে। গত ২০২০ সালের জুলাই থেকে, চীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে উদ্ভূত পণ্যের শূন্য থেকে ৯৭% পর্যন্ত অগ্রাধিকারমূলক কর হার প্রয়োগ করবে। চীন ও বাংলাদেশের অভিন্ন উন্নয়নই মূল প্রতিপাদ্য। কিন্তু চীনা বিনিয়োগের প্রতি বাংলাদেশের আকর্ষণ কীভাবে বাড়ানো যায়?

প্রথমত, বিনিয়োগ অনুমোদন প্রক্রিয়া সহজ করা উচিত এবং একটি বিনিয়োগ-বান্ধব ব্যবসায়িক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা উচিত। বিনিয়োগ পরিষেবা এবং কার্যকলাপ সম্পর্কে সচেতনতা উন্নত করতে বিনিয়োগের অসুবিধাগুলি সহজ করতে সহায়তা করে। বিনিয়োগ ফোরামের উচিত সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তে বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টিভঙ্গির দিকে আরও মনোযোগ দেওয়া। বিনিয়োগ অনুমোদনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্পে বিনিয়োগকারীদের সম্মুখীন হওয়া অসুবিধাগুলি এবং চ্যালেঞ্জগুলি গভীরভাবে বোঝা। বাংলাদেশের বাজারে অনুমোদন প্রক্রিয়া, বাছাই করা এবং বিনিয়োগের পথ সহজ করা।

দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে স্থানীয় উদ্যোগগুলিকে আশ্বাসের ভূমিকা পালনের জন্য সক্রিয়ভাবে নির্দেশনা দেওয়া উচিত। যৌথ বিনিয়োগের প্রচার, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ ও স্থানীয় উদ্যোগের মধ্যে ঝুঁকি বণ্টনের প্রচার এবং বিদেশী বিনিয়োগের প্রতি আস্থা স্থাপনের জন্য সক্রিয়ভাবে নির্দেশনা দেওয়া।

তৃতীয়ত, অগ্রাধিকারমূলক নীতি পরিকল্পনায় আরো ভাল কাজ করা প্রয়োজন, যাতে বিনিয়োগকারীদের আয়ের নিশ্চয়তা থাকতে পারে। যেসব শিল্প চালু করার জরুরী প্রয়োজন রয়েছে তাদের জন্য সম্ভাব্য বিনিয়োগকারীদের সাথে সক্রিয়ভাবে যোগাযোগ করা। বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়ার ভিত্তিতে বিনিয়োগকারীদের নীতিগত চাহিদা বোঝা প্রয়োজন।

চতুর্থত, সহায়ক সুবিধার জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিন এবং দুর্নীতি বিরোধী প্রচেষ্টা জোরদার করুন।

উপরে উল্লিখিত দিকগুলিতে বাংলাদেশ তুলনামূলক সুবিধা তৈরি করলে, বাংলাদেশে বিদেশী বিনিয়োগ অবশ্যই লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে এবং অর্থনীতি ও সমাজ সমৃদ্ধ ও উন্নত হবে।

লেখক: বাংলাদেশে চাইনিজ এন্টারপ্রাইজেস অ্যাসোসিয়েশন এর সভাপতি।